বাংলাদেশে আজ একটা ভয়ঙ্কর বাস্তবতা দাঁড়িয়ে আছে। এখানে প্রচুর মানুষ কাজের জন্য উৎসাহী না, বরং রাজনীতির শরণ নিচ্ছে। খুব সহজ কথায় বললে, পরিশ্রম না করে দ্রুত সফল হওয়ার এমন একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে, যেটা সমাজ এবং দেশের জন্য মারাত্মক। যারা প্রকৃতভাবে রাজনীতির জন্য উপযুক্ত না, তাদের একটা বড় অংশই রাজনীতিতে ঢুকে পড়ছে শুধু সুযোগ নিতে। এতে আমরা একদিকে রাজনীতিকে কলুষিত করছি, অন্যদিকে পুরো সমাজকে এক নষ্ট পথে ঠেলে দিচ্ছি।
মগজ ধোলাই: তরুণদের বিভ্রান্ত করার কৌশল
আজকের বাংলাদেশে অনেক তরুণ রাজনীতির ফাঁদে পড়ছে। আসলে তাদের কাছে কাজের জন্য যোগ্যতা আর পরিশ্রমের মানে হারিয়ে গেছে। একটা প্রচলিত ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ক্ষমতা থাকলেই সম্মান, টাকাপয়সা, আর স্বাচ্ছন্দ্য সবই আসবে। এই তরুণদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতিকে ক্ষমতা আর সুযোগের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে, নেতাদের বশীভূত হয়ে চলে। তাদের কানে প্রতিনিয়ত ঢোকানো হয়—“তুমি তো যোগ্য, রাজনীতির হাত ধরলে তোমার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত।” কিন্তু আসলে, এই কথাগুলোই তাদের নিজের বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। কাজের জন্য যে একনিষ্ঠতা দরকার, সেই মনোভাব তারা হারাচ্ছে।
আমরা যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই, সেখানে কিন্তু রাজনীতির লক্ষ্য আর বাস্তবতা একেবারেই আলাদা। ইউরোপ বা আমেরিকায় তরুণদের রাজনীতিতে আসার মানে হলো সমাজে ভালো কিছু করা। সেখানে রাজনীতির প্রথম কাজ হলো সেবা করা এবং দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নেওয়া। কিন্তু আমাদের তরুণদের মাথায় ঢুকানো হচ্ছে যে, রাজনীতি মানেই ক্ষমতার সহজ রাস্তা।
পরিশ্রমকে অপমান: সমাজে কাজকে অবজ্ঞা করার সংস্কৃতি
আমাদের দেশে একটা বড় সমস্যা হলো, পরিশ্রমকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এখানে কাজ করাকে অনেকেই নীচুস্তরের কাজ মনে করে। অনেক তরুণ শুধুমাত্র পরিশ্রমকে অপমান করেই রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ছে, কারণ এতে তাদের একটা ঝামেলাবিহীন সুযোগের হাতছানি দেখা যায়। তাদের মনে কাজ করার তাগিদ কমে গেছে।
আমরা দেখলে বুঝতে পারবো, উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি পরিশ্রম আর উদ্যমের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সেসব দেশে কাজের প্রতি একটা শ্রদ্ধা আছে; যে কেউ পরিশ্রম করে সম্মানিত। আর আমাদের দেশে? অধিকাংশ মানুষই অল্প পরিশ্রমে বেশি কিছু পাওয়ার আশায় রাজনীতিতে ঢুকে পড়ছে। এই মানসিকতা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কাজে মনোযোগী হতে বাধা দিচ্ছে।
চাঁদাবাজি: রাজনীতির নামে অর্থনৈতিক সন্ত্রাস
চাঁদাবাজি এখন রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে যেখানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ রাজনীতিকে একটা ‘চাঁদাবাজি মেশিন’ হিসেবে ব্যবহার করছে। এটা এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, অনেকেই মনে করে রাজনীতিতে থাকা মানেই নিজের ইচ্ছেমতো অর্থ আদায়ের ক্ষমতা। আমাদের সমাজে চাঁদাবাজির এই সংস্কৃতি পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোকে ভেঙে দিচ্ছে।
চাঁদাবাজি বলতে যা বোঝায়, তা হলো ক্ষমতার জোরে অর্থ আদায়। রাজনীতিবিদেরা নিজেদের প্রভাবের কারণে ব্যবসায়ীদের থেকে টাকা আদায় করে, কখনো কখনো সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও। উন্নত দেশে রাজনীতিবিদদের কাজে কোনোরকম চাঁদাবাজি বরদাস্ত করা হয় না। সেখানে রাজনীতির একটা শৃঙ্খলা আছে। কিন্তু আমাদের দেশে, বিশেষ করে স্থানীয় রাজনীতিতে, চাঁদাবাজি যেন একটা শৌখিন কাজে পরিণত হয়েছে।
সন্ত্রাস আর ক্ষমতার দাপট: সমাজকে অস্থিরতার মধ্যে ফেলা
চাঁদাবাজি ছাড়াও, রাজনীতির সঙ্গে সন্ত্রাসের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ক্ষমতার লোভে কিছু অসৎ রাজনীতিবিদরা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত হয়ে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এই সন্ত্রাসের কারণে সাধারণ মানুষের জীবন এবং নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। অথচ, উন্নত দেশগুলোতে রাজনীতিতে এমন অস্থিরতা তৈরি করার কোনো সুযোগ নেই। সেসব দেশের রাজনীতিবিদেরা যদি কোনো সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত হয়, তবে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
কিন্তু আমাদের দেশে এই দায়িত্ববোধের অভাব দেখা যায়। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে যখন দেখা যায় যে ক্ষমতা আছে, সন্ত্রাসের জোরে কিছু করা যায়, তখন তারা আর নিজের যোগ্যতা বা পরিশ্রমে কিছু করতে চায় না। সমাজের জন্য এটা বিশাল একটা ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উন্নত দেশ ও আমাদের মধ্যে পার্থক্য: কাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি
উন্নত দেশগুলোতে রাজনীতির অর্থ হলো সমাজকে এগিয়ে নেওয়া। তরুণেরা কাজ করে, ব্যবসায় এগিয়ে যায়, এবং চাকরির মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। সেখানে কেউ রাজনীতিতে এলে সেটা থাকে সমাজের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থেকে। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতিতে প্রবেশ মানে যেন একধরনের ছাড়পত্র পাওয়া। যারা কাজ করতে চায় না, তারা ক্ষমতার বলয়ে ঢুকে নিজ স্বার্থে সমাজকে কাজে লাগায়। এটা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক মারাত্মক পরিস্থিতি।
উন্নত দেশে একজন রাজনীতিবিদ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কঠোর আইনানুগতা মেনে চলে। আমাদের দেশে সেই সচেতনতা একেবারেই অনুপস্থিত। তাই তরুণেরা রাজনীতির ফাঁদে পা দেয় এবং দ্রুত সুবিধা আদায়ের স্বপ্নে বিভোর হয়।
পরিশ্রমী সমাজ গড়তে কীভাবে এই মনোভাব বদলাতে হবে
এই পরিস্থিতি বদলাতে হলে, আমাদের সমাজে কাজের প্রতি সম্মান ফিরিয়ে আনতে হবে। তরুণদের মনের মধ্যে যে ধারণা ঢুকেছে যে রাজনীতি মানেই সহজ টাকা আর কম পরিশ্রম, সেটি সরিয়ে পরিশ্রম এবং নিজের চেষ্টায় সফল হওয়ার গুরুত্ব তৈরি করতে হবে। রাজনীতিতে আসা মানে যদি সেবা হয়, তাহলে সমাজের দায়িত্ববোধ তৈরি হবে। কিন্তু, সবার আগে সমাজকে শিক্ষা দিতে হবে—রাজনীতি কেবল ক্ষমতার খেলায় নয়, বরং সমাজকে সেবার সুযোগ।
আসুন, সমাজের জন্য কাজ করা আর সঠিক পথে এগিয়ে চলার এক সুন্দর সংস্কৃতি গড়ে তুলি।
Leave a Reply