ঢাকা শহরের রাস্তায় চলাফেরা করতে গেলে মনে হবে যেন একটা হর্নের কারখানার ভেতরে আছি। প্রতিটা বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, সিএনজি, মোটরসাইকেল, আর সেই বিশেষ ‘মহামূল্যবান’ অটো রিকশা—সবই যেন ‘হর্ন’ বাজানো ছাড়া চলতে জানে না। যে যেখানেই যাচ্ছে, সেখানেই অযথা হর্ন বাজাচ্ছে। পিছনে আছে ‘হর্ন’, ডানে আছে ‘হর্ন’, বামে আছে ‘হর্ন’, এমনকি সামনে থাকলেও তারা হর্ন বাজায়। জ্যামে বসে হর্ন বাজায়, সিগন্যালে হর্ন বাজায়। এমন অসহনীয় পরিস্থিতি আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ! ভাই, হর্ন বাজালেই কি সামনে থাকা গাড়িগুলো হাওয়া হয়ে যাবে? জাদু নাকি? নাকি আমাদের দেশের ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষায় প্রশ্ন আসে, “কতভাবে হর্ন বাজানো যায়?”
ঢাকার রাস্তা মোটেও প্রশস্ত নয়; সেই অল্প জায়গায় গিজগিজ করছে হাজারো যানবাহন। আর সবাই মিলে একসাথে হর্ন বাজানো শুরু করলে কী হয়, সেটা নতুন করে বলার কিছু নেই। কেন এই শহরের চালকরা কোনো কারণ ছাড়াই হর্ন বাজাতে থাকেন? তাদের কি মনে হয়, রাস্তার মালিকানা তাদের হাতে? আমাদের রাস্তাগুলোতে যেভাবে হর্ন বাজানো হয়, সেটা একটা নিরবচ্ছিন্ন অত্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়।
অটো রিকশার হর্ন—শব্দের যন্ত্রণায় নতুন মাত্রা
অটো রিকশা চালকদের মধ্যে যেন একটা নেশা আছে—প্রতি দু’মিনিট পর পর হর্ন বাজাতে হবে। হর্নে চাপ দিয়ে ধরে ওভারটেক করে চলার প্রবণতাও দেখা যায়। গন্তব্যে যেতে পথচারীদের কানে একাধিকবার শব্দের ঝাঁকুনি দিয়ে যেন তারা তৃপ্তি পান! এটাই কি তাদের কাজ, নাকি এই হর্ন বাজানো ছাড়া রাস্তায় চলার আর কোনো উপায় নেই?
মোটরসাইকেল চালক ও ফুটপাথে হর্ন বাজানো—নৈরাজ্যের আরেক রূপ
আর মোটরসাইকেল চালকরা কবে শিখবে ভাই? ঢাকায় অটো রিকশার পর সবচেয়ে বেশি হর্ন বাজান এই মোটরসাইকেল চালকদের। উল্টাপাল্টা চালানো তো আছেই; ওভারটেক করাটা যেন তাদের জন্য একটা নেশা। ডানে দিয়ে, বামে দিয়ে, চিপা দিয়ে, যেভাবেই হোক, ওভারটেক তাদের করতেই হবে। তাতে যত রিস্কই থাকুক না কেন, ‘হর্ন’ বাজিয়ে জানান দেবে যে ‘আমি চিপায় ঢুকেছি, আমাকে যেতে দে!’ আর ফুটপাথে উঠেও পথচারীদের বিরক্ত করা যেন তাদের খাওয়া দাওয়ার মতো জরুরি কাজ। দুই বেলা ভাত খাবার মতো এদের দুই বেলা ফুটপাথে উঠতেই হবে। আর ফুটপাথে উঠে এমন একটা ভাব নিবে যেন সেই নবাব সিরাজুদ্দৌলার বংশধর।
বাস, ট্রাক, এবং প্রাইভেট কারের হর্নের নির্যাতন
বাস, ট্রাক, আর প্রাইভেট কার চালকেরাও কম যান না। জ্যামে আটকে পড়লে মনে হয় যেন বারবার হর্ন বাজিয়ে জ্যামকেই অদৃশ্য করে দিতে পারবেন! কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এসব হর্ন বাজানো আমাদের জীবনকে আরও অস্থির করে তুলছে। শুধু কানের ক্ষতি নয়, এই শব্দদূষণ মনের ওপরও একধরনের হিংস্র আঘাত হানে। আমাদের শান্তি কেড়ে নেয়, শিশুদের মনোযোগ নষ্ট করে, রোগীদের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে।
কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই এরা হর্ন বাজায়। সামনে হাসপাতাল, স্কুল, কিংবা অন্য যে কোনো সংবেদনশীল স্থান থাকুক, তাতে তাদের কিছুই আসে যায় না। বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময় অনেক প্রাইভেট কারের চালক শুধু হর্ন দেয়া নিয়ে গার্ড বা অভিভাবকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন, যেন হর্ন না বাজাতে বলায় তাদের সম্মানহানি হচ্ছে।
একটু শালীনতা, একটু সহনশীলতা কি এত কঠিন?
প্রতিটা চালকের কি এই বিবেকবোধ টুকুও নাই যে যখন দরকার নেই, তখন হর্ন বাজাবেন না? হর্ন বাজানো কোনো বিশেষ অধিকারের বিষয় নয়, বরং এটা দায়িত্বহীনতার উদাহরণ। আমাদের উচিত একে অন্যের প্রতি দায়িত্বশীল থাকা এবং বুঝতে চেষ্টা করা যে, রাস্তায় আমাদের কিছু শালীনতা বজায় রাখার দায়িত্ব আছে।
ঢাকা শহরের প্রতিটি মানুষ শান্তিতে বাঁচার অধিকার রাখে। রাস্তার পরিবেশকে একটু সহনশীল করার চেষ্টা কি খুব কষ্ট? যারা রাস্তায় চলেন, তারা নিশ্চয়ই চাইবেন না এই অনিয়ন্ত্রিত হর্নের দৌরাত্ম্য চলতেই থাকুক। মনে রাখবেন, এই হর্ন বাজানো শুধু আমাদের বিরক্ত করছে না, আমাদের নিজেদের শরীরেও এর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
পরিশেষে বলব, হর্ন বাজানো কোনো ক্ষমতা নয়, বরং এটা বিবেকের বিষয়। একটু সচেতন হলেই হয়তো ঢাকার রাস্তাগুলো একটু শান্ত হবে।
Leave a Reply